অথ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা প্রারভ্যতে
‘অর্জ্জুনবিষাদযোগ’
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ।
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয় || ১ ||
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন- হে সঞ্জয়! ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া আমার পক্ষ ও পাণ্ডবেরা কি করিল?
ব্যাখ্যাঃ— প্রসিদ্ধ
টীকাকার অভিনব গুপ্ত তাঁর টীকায় শ্রীগীতার অর্জুন-বিষাদযোগের প্রথম শ্লোকটিকে আধ্যাত্মিক
ভাবে গ্রহণ করেছেন। কুরু (করণ) অর্থাৎ ইন্দ্রিয়; তার ক্ষেত্র দেহ— যেখানে ধর্মাধর্মাদির
ব্যবহার হয়। কুরুপাণ্ডব যুদ্ধকে তিনি দেবাসুর বা বিদ্যাবিদ্যার সংগ্রাম বলেছেন, যা
এই দেহেতে ক্রমাগত চলছে। কিঞ্চিৎ বিদ্যা (জ্ঞান) এবং কিঞ্চিৎ অবিদ্যার (অজ্ঞানের) সম্মিলনই
সংশয়। দেবতা ও অসুরের সৃষ্টি এই বিদ্যা ও অবিদ্যার আধিক্য হতে। সেই বিদ্যা ও অবিদ্যার
কথা আরম্ভই মোক্ষমার্গের উপদেশ—
'কুরু'
অর্থাৎ করণ (ইন্দ্রিয়সকলের) 'ক্ষেত্র' অর্থাৎ অনুগ্রহজনক বা শরীর। অতএব সমস্ত সাংসারিক
ধর্মের উৎপত্তির কারণ বলে ক্ষেত্র— অর্থাৎ স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর। আবার 'যোগের দ্বারা
আত্ম-দর্শনই পরম ধর্ম'—এই হচ্ছে ধর্মের ক্ষেত্র। অর্থাৎ সমস্ত অধর্মের ক্ষয়হেতু মুক্তিপ্রাপ্তি
হওয়ায় সংসারের ত্রাণস্বরূপ জ্ঞানাধিকারীর শরীর। সমস্ত শরীরেই ইন্দ্রিয়গুলির বৃত্তির
পরস্পর হিংসা হয় বলে পরস্পর বাধ্য-বাধকরূপে যে শরীরে রাগ, বৈরাগ্য, ক্রোধ, ক্ষমা প্রভৃতির
সম্মিলন হয় সেই শরীরে বিদ্যমান যে 'মামকা' অর্থাৎ অজ্ঞানী পুরুষোচিত অজ্ঞানের সংকল্প
সকল আর 'পাণ্ডবা' অর্থাৎ শুদ্ধজ্ঞানী পুরুষোচিত জ্ঞানের সংকল্প সকল— তাহারা কি করিল?
সঞ্জয় উবাচ।
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা।
আচার্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ || ২ ||
সঞ্জয় বলিলেন- তৎকালে ব্যূহাকারে সজ্জিত পাণ্ডবসৈন্য দেখিয়া রাজা দুর্য্যোধন আচার্য্যের সমীপে গিয়া
বলিলেন-
পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য্য মহতীং চমূম্।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা || ৩ ||
হে আচার্য্য! আপনার
ধীমান্ শিষ্য দ্রুপদপুত্রের দ্বারা ব্যূহাকারে সজ্জিত পাণ্ডবদিগের মহতী সেনা দর্শন করুন।
অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জ্জুনসমা যুধি।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ || ৪ ||
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান্।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ || ৫ ||
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্য্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এব মহারথাঃ || ৬ ||
ইহার মধ্যে শূরবীর, ধনুর্ব্বাণক্ষেপে মহান্,
যুদ্ধে ভীমার্জ্জুনসম, যুযুধান, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশীরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ,
নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর্য্যবান্
উত্তমৌজা, সুভদ্রাপুত্র, দ্রৌপদীর
পুত্রগণ, ইঁহারা সকলে মহারথ।
অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে || ৭ ||
ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ || ৮||
অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্ব্বে যুদ্ধবিশারদাঃ || ৯ ||
হে দ্বিজোত্তম! যাঁহারা আমার সৈন্যের
নায়ক, তাঁহাদিগকে অবগত হউন।
বিশেষভাবে অবগতির জন্য সে সকল আপনাকে
বলিতেছি। আপনি (দ্রোণাচার্য্য), ভীষ্ম,
কর্ণ, সমরজয়ী কৃপ,
অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র। আরও অন্যান্য বহু শূরবীর আমার জন্য ত্যক্তজীবন হইয়াছেন অর্থাৎ জীবনত্যাগে প্রস্তুত হইয়াছেন। তাঁহারা সকলে নানাশস্ত্রধারী এবং যুদ্ধবিশারদ।
অপর্য্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্।
পর্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ || ১০ ||
ভীষ্ম কর্তৃক রক্ষিত আমাদের সেই সৈন্যবল অপর্য্যাপ্ত। আর ইহাদিগের ভীম কর্তৃক
রক্ষিত সৈন্যবল পর্য্যাপ্ত।
অয়নেষু চ সর্ব্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি || ১১ ||
আপনারা সকলেই স্ব স্ব বিভাগানুসারে সর্ব্ব বূহ্যদ্বারে অবস্থিত থাকিয়া ভীষ্মকেই সর্ব্ব দিক্ হইতে রক্ষা করিতে থাকুন।
তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্নৌ প্রতাপবান্ || ১২ ||
তখন প্রতাপবান্ কুরুবৃদ্ধ পিতামহ (ভীষ্ম)
দুর্য্যোধনের হর্ষ জন্মাইয়া উচ্চ সিংহনাদ করতঃ শঙ্খধ্বনি করিলেন।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ।
সহসৈবাভ্যহনন্ত স শব্দস্তুমূলোহভবৎ || ১৩ ||
তখন শঙ্খ, ভেরী,
পণব, আনক,
গোমুখ সকল সহসা আহত হইলে সে শব্দ তুমুল
হইয়া উঠিল।
ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে
স্থিতৌ।
মাধবঃ
পাণ্ডবশ্চৈব দিবৌ শঙ্খৌ প্রদধ্নতুঃ || ১৪ ||
তখন শ্বেতাশ্বযুক্ত মহারথে
স্থিত মাধব ও পান্ডবশ্রেষ্ঠ দিব্য শঙ্খ বাজাইলেন।
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ।
পৌন্ড্রং
দধ্নৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ || ১৫ ||
অনন্তবিজয়ং
রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ
সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ || ১৬ ||
হৃষীকেশ পাঞ্চজন্য নামে শঙ্খ, ধনঞ্জয়
দেবদত্ত এবং ভীমকর্ম্মা বৃকোদর পৌন্ড্র নামে মহাশঙ্খ বাজাইলেন। কুন্তীপুত্র রাজা
যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয়,
নকুল সুঘোষ, এবং সহদেব মণিপুষ্পক (নামে) শঙ্খ
বাজাইলেন।
ব্যাখ্যাঃ- ভগবৎপাদ্
শঙ্করাচার্য্যের বিষ্ণুসহস্রনাম শাঙ্করভাষ্য-১৯ শ্লোকে ভগবানের হৃষীকেশ নাম মাহাত্ম্যের উল্লেখিত আছে- "হৃষিক"
অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের যিনি ঈশ অর্থাৎ ঈশ্বর তিনিই পরমাত্মা হৃষীকেশ ; ইহারই
বশীভূত হয়ে ইন্দ্রিয়গণ স্ব স্ব বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়। সূর্য ও চন্দ্র তাপদান ও বস্তু প্রকাশ
করে লোক সমুদায়কে আহ্লাদিত করেন বলে হৃষী নামে অভিহিত হন। ঐ সূর্য ও চন্দ্র তাঁর কেশস্বরূপ
বা কেশ-সংস্থিত কিরণস্বরূপ, তাই তাঁর নাম হৃষীকেশ।
'হে
পান্ডুনন্দন! যিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কেশ নামক অংশুর (কিরণের) দ্বারা সর্বদা যুক্ত করে,
তাঁদের দ্বারা জগৎকে জাগরিত এবং নিদ্রিত করে তা হতে পৃথকভাবে উত্থিত হন(অর্থাৎ সর্বত্র
অসংগ থাকেন)। জগৎকে জাগরিত এবং নিদ্রিত করার জন্য তিনি জগতের হর্ষণ এবং আনন্দপ্রদানকারী
হন। তিনি তাঁর কেশ (শক্তি)-স্বরূপ অগ্নি (এখানে অগ্নি অর্থ তেজ বা সূর্য) এবং চন্দ্রের
দ্বারা জগৎকে হৃষ্ট করেন বলে হৃষীকেশ (হর্ষণ + কেশ), মহেশ্বর, বরদানকারী ও লোক (ভূঃ
প্রভৃতি লোক এবং সেই লোকবাসীগনের)-পালকরূপে চরাচরে খ্যাত হন।'-(মহাভারত শান্তিপর্ব
৩৪২।৬৬-৬৭)
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো
বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ || ১৭ ||
দ্রুপদো দ্রৌপদদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ
পৃথিবীপতে।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দুধ্নুঃ
পৃথক্ পৃথক্ || ১৮ ||
পরম ধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথ
শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন,
বিরাট, অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর
পুত্রগণ, মহাবাহু সুভদ্রাপুত্র,-হে পৃথিবীপতে!
ইঁহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খ বাজাইলেন।
স ঘোষো ধার্ত্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি
ব্যদারয়ৎ।
নভেশ্চ
পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ || ১৯ ||
সেই শব্দ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগের
হৃদয় বিদীর্ণ করিল ও নভোমন্ডল এবং পৃথিবীকে তুমুল ধ্বনিত করিল।
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা
ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ।
প্রবৃত্তে
শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ।
হৃষীকেশং
তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে || ২০ ||
অতঃপর হে মহীপতে! ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে ব্যবস্থিত দেখিয়া শস্ত্রনিক্ষেপে
প্রবৃত্ত কপিধ্বজ অর্থাৎ হনুমান চিহ্নিত পতাকা শোভিত রথারূঢ় পান্ডবশ্রেষ্ঠ (অর্জ্জুন) ধনু
উত্তোলন করিয়া হৃষীকেশকে এই কথা বলিলেন।
অর্জ্জুন উবাচ।
সেনয়োরুভয়োর্ম্মধ্যে রথং স্থাপয়
মেহচ্যুত || ২১ ||
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং
যোদ্ধুকামানবস্থিতান্।
কৈর্ময়া
সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে || ২২ ||
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং
য এতেহত্রসমাগতাঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য
দুর্ব্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ || ২৩ ||
অর্জ্জুন বলিলেন-
যাহারা যুদ্ধ-কামনায়
অবস্থিত, আমি যাবৎ তাহাদিগকে নিরীক্ষণ করি, এই রণসমুদ্যমে কাহাদিগের সঙ্গে
আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে (যাবৎ তাহা দেখি),
যাহারা দুর্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রের প্রিয়চিকীর্ষায় এইখানে
যুদ্ধে সমাগত হইয়াছে,
সেই সকল যুদ্ধার্থীদিগকে (যাবৎ) আমি
দেখি, (তাবৎ) হে অচ্যুত! তুমি উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর।
সঞ্জয় উবাচ।
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে
স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম || ২৪ ||
ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ
সর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্।
উবাচ
পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি || ২৫ ||
সঞ্জয় বলিলেন-
হে ভারত!
জিতনিদ্র (অর্জ্জুন) কর্ত্তৃক হৃষীকেশ
(বাসুদেব) এইরূপ অভিহিত হইয়া উভয় সেনার মধ্যে ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখ সকল
রাজগণের সম্মুখে সেই উৎকৃষ্ট রথ স্থাপন করিয়া কহিলেন, হে
পার্থ সমবেত কুরুগণকে এই দর্শন কর।
তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পশ্যৈতান্
পিতৃনথ পিতামহান্।
আচার্য্যান্মাতুলান্
ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা ||
শ্বশুরান
সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি || ২৬ ||
তখন অর্জ্জুন সেইখানে স্থিত উভয়
সেনায় পিতৃব্যগণ,
পিতামহগণ, আচার্য্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, শ্বশুরগণ, সখিগণ এবং সুহৃদ্গণকে দেখিলেন।
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান্
বন্ধূনবস্থিতান্।
কৃপয়া
পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ || ২৭ ||
সেই কুন্তীপুত্র সেই সকল
বন্ধুগণকে অবস্থিত দেখিয়া,
পরম কৃপাবিষ্ট হইয়া বিষাদপূর্ব্বক এই কথা বলিলেন।
অর্জ্জুন উবাচ
দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূন্
সমবস্থিতান্।
সীদন্তি
মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি || ২৮ ||
অর্জ্জুন বলিলেন-
হে কৃষ্ণ! এই
যুদ্ধেচ্ছু সম্মুখে অবস্থিত স্বজনগণকে দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ
শুষ্ক হইতেছে।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।
গাণ্ডীবং
স্রসংতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে || ২৯ ||
আমার শরীর কাঁপিতেছে, রোমহর্ষ
জন্মিতেছে, হস্ত হইতে গাণ্ডীব খসিয়া পড়িতেছে এবং ত্বক দাহ হইতেছে।
ন চ শক্লোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ।
নিমিত্তানি
চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব || ৩০ ||
হে কেশব! আমি আর
থাকিতে পারিতেছি না,
আমার মন যেন ভ্রমিত হইতেছে, আমি বিপরীত লক্ষণ সকল
দর্শন করিতেছি।
ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন
কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ || ৩১ ||
যুদ্ধে স্বজনদিগকে হত্যা করায়
আমি কোন শ্রেয় দেখি না-হে কৃষ্ণ! আমি বিজয় আকাঙ্খা করি না, রাজ্যসুখও না।
ব্যাখ্যাঃ- বিষ্ণুসহস্রনাম
স্তোত্রম্ এ শ্রীভগবানের এক নাম 'কৃষ্ণ' নামের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। ভগবৎপাদ্
শঙ্করাচার্য্যের বিষ্ণুসহস্রনাম শাঙ্করভাষ্য-২০ এ বর্ণিত আছে-'কৃষি শব্দ ভূমিবাচক এবং
ন শব্দ নিবৃত্তিবাচক, বিষ্ণু এই উভয় ভাব সংযুক্ত হেতু শাশ্বত কৃষ্ণ নামে অভিহিত।'-(মহাভারত
উদ্যোগপর্ব ৭০।৫)
ব্যাস
বলছেন-সচ্চিদানন্দাত্মক কৃষ্ণ, কৃষ্ণবর্ণহেতু কৃষ্ণ নামে খ্যাত। 'হে
অর্জুন, যেহেতু আমি 'কার্ষ্ণায়স' অর্থাৎ লৌহনির্মিতহল-স্বরূপ হয়ে পৃথিবী কর্ষণ করি
এবং আমার বর্ণ কৃষ্ণ, সেই হেতু আমি কৃষ্ণ।'-(মহাভারত শান্তিপর্ব ৩৪২।৭৯)
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং
ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে
কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ || ৩২ ||
ত
ইহেনবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।
আচার্য্যাঃ
পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ || ৩৩ ||
মাতুলাঃ
শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন
হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূধন || ৩৪ ||
যাহাদিগের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখ
কামনা করা যায়,
সেই আচার্য্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালা
এবং সম্বন্ধিগণ যখন ধন প্রাণ ত্যাগ করিয়া এই যুদ্ধে অবস্থিত, তখন হে
গোবিন্দ! আমাদের রাজ্যেই কাজ কি,
ভোগেই কাজ কি, জীবনেই কাজ কি? হে
মধুসূদন! আমি হত হই হইব,
তথাপিও তাহাদিগকে হত্যা করিতে ইচ্ছা করি না।
ব্যাখ্যাঃ- বিষ্ণুসহস্রনাম
স্তোত্রম্ এ শ্রীভগবানের এক নাম 'গোবিন্দ' নামের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে।ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের
বিষ্ণুসহস্রনাম শাঙ্করভাষ্য-৩৩ এ বর্ণিত আছে- 'মোক্ষধর্মে
লিখিত আছে যে, শ্রীহরি বলেছেন-আমি প্রনষ্টা ধরণীকে উদ্ধার করেছিলাম বলে দেবগণ আমাকে
গোবিন্দ নামে স্তব করে থাকেন।'-(মহাভারত, শান্তিপর্ব- ৩৪২।৭০)
হরিবংশে
আছে-'আমি দেবতাদের অধিপতি ইন্দ্র, কিন্তু হে কৃষ্ণ তুমি পৃথিবীর আধিপত্য প্রাপ্ত হয়েছ,
এইজন্য লোকে চিরকাল তোমাকে গোবিন্দ বলে স্তব করবে।'-(হরিবংশ ২।১৯।৪৫) হরিবংশে
আরও আছে-'গো' শব্দে বাণী, হরি সেই বাণীকে লাভ করেছেন, এই হেতু দেবগণ ও মুনিগণ তাঁকে
গোবিন্দ বলে স্তব করেছেন।-(হরিবংশ ৩।৮৮।৫০)
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিন্নু
মহীকৃতে।
নিহত্য
ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দ্দন || ৩৫ ||
মহীর (পৃথিবীর) কথা
দূরে থাক, ত্রৈলোক্যের রাজ্যের জন্যই বা ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণকে নিহত করিলে কি প্রীতি
হইবে, জনার্দ্দন?
পাপমেবাশ্রয়েদদ্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ
তস্মান্নার্হা
বয়ং হন্তুং ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্।
স্বজনং
হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব || ৩৬ ||
এই আততায়ীদিগকে হত্যা করিলে
আমাদিগকে পাপ আশ্রয় করিবে,
অতএব আমরা সবান্ধব ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদিগকে
হত্যা করিতে পারিব না। হে মাধব! স্বজন হত্যা করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব?
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং
দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ || ৩৭ ||
কথং
ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্ত্তিতুং।
কুলক্ষয়কৃতং
দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দ্দন || ৩৮ ||
যদ্যপি ইহারা লোভে হতচিত্ত হইয়া
কুলক্ষয়দোষ এবং মিত্রদ্রোহে যে পাতক, তাহা দেখিতেছে না, কিন্তু
হে জনার্দ্দন! আমরা কুলক্ষয় করার দোষ দেখিতেছি, আমরা সে পাপ হইতে নিবৃত্তিবুদ্ধিবিশিষ্ট
কেন না হইব?
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মাঃ
সনাতনাঃ।
ধর্ম্মে
নষ্টে ও কুলং কৃৎস্নমধর্ম্মোহভিভবত্যুত || ৩৯ ||
কুলক্ষয়ে সনাতন কুলধর্ম্ম নষ্ট
হয়। ধর্ম্ম নষ্ট হইলে অবশিষ্ট কুল অধর্ম্মে অভিভূত হয়।
অধর্ম্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি
কুলস্ত্রিয়ঃ।
স্ত্রীষু
দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ || ৪০ ||
হে কৃষ্ণ! অধর্ম্মাভিভবে
কুলস্ত্রীগণ দুষ্টা হয়,
স্ত্রীগণ দুষ্টা হইলে, হে বার্ষ্ণেয়! বর্ণসঙ্কর জন্মায়।
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি
পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ || ৪১ ||
এই সঙ্কর কুলনাশকারীদিগের ও
তাহাদের কুলের নরকের নিমিত্ত হয়। পিণ্ডোদকক্রিয়ার লোপ হেতু তাহাদিগের পিতৃগণ পতিত
হয়।
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্কররকারকৈঃ।
উৎসাদ্যন্তে
জাতিধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ || ৪২ ||
এইরূপ কুলঘ্নদিগের
বর্ণসঙ্করকারক এই দোষে জাতিধর্ম্ম এবং সনাতন কুলধর্ম্ম উৎসন্ন যায়।
উৎসন্নকুলধর্ম্মানাং মনুষ্যাণাং
জনার্দ্দন।
নরকে
নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রম || ৪৩ ||
হে জনার্দ্দন! আমরা
শুনিয়াছি যে, যে মনুষ্যদিগের কুলধর্ম উৎসন্ন যায়, তাহাদিগের নিয়ত নরকে বাস হয়।
অহো বত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ং।
যদ্রাজ্যসুখলোভেন
হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ || ৪৪ ||
হায়! আমরা
রাজ্যসুখলাভে স্বজনকে হত্যা করিতে উদ্যত হইয়াছি-মহৎ পাপ করিতে অধ্যবসায় করিয়াছি।
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রা
রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ || ৪৫ ||
যদি আমি প্রতীকারপরাঙ্মুখ এবং
অশস্ত্র হইলে শস্ত্রপাণি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ যুদ্ধে আমাকে হত্যা করে, তাহাও
আমার পক্ষে অপেক্ষাকৃত মঙ্গলকর হইবে।
সঞ্জয় উবাচ।
এবমুক্ত্বার্জ্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ
উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য
সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ || ৪৬ ||
সঞ্জয় বলিলেন-
অর্জ্জুন এইরূপ বলিয়া শোকাকুল মানসে
ধনুশর পরিত্যাগ করিয়া সংগ্রামস্থলে রথোপস্থে উপবেশন করিলেন।
ইতি
শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্বণি শ্রীভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু
ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে
অর্জ্জুনবিষাদযোগ
নাম
প্রথমোঽধ্যায়ঃ।
ॐ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।
॥ শ্রীবেদব্যাসায় নমঃ॥
No comments:
Post a Comment