মহর্ষি বাদরায়ণ উত্তরমীমাংসা বেদান্তদর্শনের ১ম অধ্যায়ের তৃতীয় পাদের ২৯ সূত্রে বেদের নিত্যতাকে দৃঢ় করিতেছেন-
'অতএব চ নিত্যত্বম্'।।-(ব্রহ্মসূত্র ১।৩।২৯)
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ভাবার্থঃ-
সেই স্থিত-সিদ্ধ বেদনিত্যতাকেই সূত্রকার দৃঢ় করিতেছেন- অতএব, অর্থাৎ নিয়ত জাতিবিশিষ্ট যে দেবাদি জগৎ, তাহা বৈদিক শব্দ হইতে উৎপন্ন হয় বলিয়া বৈদিক শব্দের নিত্যতাও স্বীকার করিতে হইবে। যেমন ‘যজ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ন্তামন্ববিন্দন্নৃষিষু প্রবিষ্টাম্।'-(ঋগ্বেদসংহিতা-১০।৭১।৩) যজ্ঞের অর্থাৎ পূর্ব্বকৃত পূণ্যকর্ম্মের দ্বারা বাক্যের অর্থাৎ বেদের পদবীয়কে অর্থাৎ লাভযোগ্যতাকে প্রাপ্ত হইয়া বিশ্বামিত্রাদি যাজ্ঞিকগণ ঋষিগণের মধ্যে প্রবিষ্ট অর্থাৎ স্থিত তাহাকে অর্থাৎ- সেই বেদকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্রবর্ণ স্থিত ও অনুবিন্ন অর্থাৎ পূর্ব্ব হইতে অবস্থিত ও উপলব্ধ বেদকেই প্রদর্শন করিতেছে। শ্রীমহাভারতে বেদব্যাসও এইপ্রকার স্মরণ করিতেছেন, যথা-'যুগান্তেন্তর্হিতান্বেদান্সেতিহাসান্মহর্ষযঃ৷ লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতাঃ স্বযংভুবা '-(মহাভারত শান্তিপর্ব-২১০।১৯) পূর্বকল্পে যাহারা বিদ্যমান ছিলেন যুগান্তে অন্তর্হিত ইতিহাসের সহিত সেই বেদসকলকে মহর্ষিগণ স্বয়ম্ভু ব্রহ্মাকর্তৃক অনুজ্ঞাত অর্থাৎ উপদিষ্ট হইয়া পূর্ব্বে কল্পাদিতে লাভ করিয়াছিলেন।
এতদ্বিষয়ে পূর্বের সূত্রে অর্থাৎ ব্রহ্মসূত্রের ১ম অধ্যায়ের তৃতীয় পাদের ২৮ সূত্রের শাঙ্করভাষ্যে আরও অনেক শাস্ত্রপ্রমাণ রহিয়াছে। যথাঃ- এইরূপ অন্যস্থলেও 'স মনসা বাচং মিথুনং সমভবত্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১।২।৪)-তিনি মনের সহিত বাক্ কে অর্থাৎ বেদকে মিথুনীকৃত করিলেন অর্থাৎ মনের দ্বারা শ্রুতিপঠিত সৃষ্টিক্রম পর্য্যালোচনা করিলেন। ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যের দ্বারা তত্তৎস্থলে শব্দপূর্ব্বিকা সৃষ্টি শ্রবণ করানো হইতেছে। স্মৃতিও শব্দপূর্ব্বিকা সৃষ্টির কথা বলিতেছেন-' 'অনাদিনিধনা নিত্যা বাগুত্সৃষ্টা স্বযংভুবা৷ আদৌ বেদমযী দিব্যা যতঃ সর্বাঃ প্রবৃত্তযঃ'।-(মহাভারত ১২।২৩১।৫৬-৫৭)- কল্পের আদিতে রূপসৃষ্টির পূর্বে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মা কর্তৃক দিব্য, নিত্য এবং অনাদি নিধন অর্থাৎ আদিঅন্তবিহীন বেদময়ী বাণী উচ্চারিত হইয়াছিল, যাহা হইতে সকলপ্রকার প্রবৃত্তি হইয়াছে, ইত্যাদি। 'বেদময়ী বাণী উচ্চারিত হইয়াছিল'-ইহার দ্বারা বেদ পুরুষরচিত, এইপ্রকার আশঙ্কার উদয় হয়, তাহা নিবারণের জন্য বলিতেছেন-বাণীর এই উৎসর্গ অর্থাৎ বেদের এই উচ্চারণ সম্প্রদায় প্রবর্ত্তনাত্মক অর্থাৎ শিষ্যকে বেদপ্রদানাত্মক অধ্যয়নরূপ বুঝিতে হইবে। যেহেতু যাহা আদি ও অন্তহীন, তাহার অন্যপ্রকার উচ্চারণ অর্থাৎ কেহ যে স্বয়ং রচনা করিয়া অন্যকে শ্রবণ করাইতেছেন এমন সম্ভব নহে।
এইরূপে আবার ‘সর্বেষাং তু স নামানি কর্মাণি চ পৃথক্ পৃথক্।বেদশব্দেভ্য এবাদৌ পৃথক্-সংস্থাশ্চ নির্মমে’।। (মনুসংহিতা-১।২১)।। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রারম্ভে হিরণ্যগর্ভরূপে অবস্থিত এই পরমাত্মা বেদ থেকে (পূর্ব-পূর্ব কল্পের যার যেমন নামাদি ছিলো তা) অবগত হইয়া সকলের নাম (যেমন, গোজাতির অন্তর্গত গো, অশ্ব-জাতির অশ্ব প্রভৃতি), কর্ম (যেমন ব্রাহ্মণের অধ্যয়নাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষণাদি), এবং নানারকম লৌকিকী ক্রিয়া (যেমন, ব্রাহ্মণের যাজনাদি, কুলালের ঘটনির্মাণ, তন্তুবায়ের পটনির্মাণ প্রভৃতি) পৃথক পৃথক ভাবে (অর্থাৎ পূর্বকল্পের যাহার যেমন ছিলো সেইভাবে) নির্দেশ করিলেন। এই প্রকার স্মৃতিও আছে।
সৃষ্টির পূর্ব্বে স্রষ্টা প্রজাপতির মনে বৈদিক শব্দসকল প্রাদুর্ভূত হইয়াছিল (শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-৫।২, ৬।১৮), তদনন্তর তাহাতে অনুগত অর্থাৎ বর্ণিত বিষয়সকল তিনি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, ইহা অবগত হওয়া যাইতেছে অর্থাৎ অনুমতি হইতেছে। এই প্রত্যক্ষ ও অনুমান সিদ্ধ বিষয়ে শ্রুতি বাক্যরূপ প্রমাণ প্রদর্শন করিতেছেন-
'স ভূরিতি ব্যাহরত্ স ভূমিমসৃজত'-(তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-২।২।৪।২) তিনি 'ভূ' ইহা উচ্চারণ করতঃ ভূমিকে সৃষ্টি করিয়াছেন। ইত্যাদি শ্রুতি স্রষ্টা মনে প্রাদুর্ভূত ভূঃ প্রভৃতি শব্দ সকল হইতেই ভূরাদি লোকসকল সৃষ্ট হইয়াছে ইহা প্রদর্শন করিতেছেন।.................
ভগবৎপাদ্ মহাপ্রাজ্ঞ শঙ্করাচার্য্য স্বীয় ভাষ্যে মহর্ষি বাদরায়ণের বেদের এই নিত্যতা বিষয়ক সিদ্ধান্তকে আরও বহু শাস্ত্রীয় যুক্তি দ্বারা সিদ্ধ করিয়াছেন। এইখানে কিছু মূল অংশ তুলে ধরা হইয়াছে।
No comments:
Post a Comment