ছান্দোগ্য শ্রুতির তৃতীয় অধ্যায়ের চতুর্দশ খণ্ডে বর্ণিত আছে-
‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, তজ্জলানীতি শান্ত উপাসীত। অথ খলু ক্রতুময় পুরুষো যথা ক্রতুময়রর্স্মিন্ লোকে পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্রেত্য ভবতি, স ক্রতুং কুর্বীত।। (সামবেদীয় ছান্দোগ্যোপনিষদ্-৩/১৪/১)।।
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ-
পুনশ্চ, অনন্তগুণসম্পন্ন, অনন্তশক্তি এবং অনেক প্রকারে উপাসনীয় ত্রিপাদ অমৃতময় ব্রহ্মের বিশিষ্টপ্রকার গুণ ও শক্তি পুরস্কারে উপাসনা বিধানের জন্য (বক্ষ্যমাণ উপায়) নির্দেশ করিতেছেন—সৰ্ব্ব অর্থ-সমস্ত ; ‘খলু’ পদটি বাক্যের শোভাবৰ্দ্ধক নিপাত। ‘ইদং’ অৰ্থ-নাম ও রূপাকারে পরিণত এবং প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের বিষয়ীভূত। এই জগৎ ব্ৰহ্মস্বরূপ-কারণস্বরূপ ; বৃদ্ধতম অর্থাৎ অতিশয় প্ৰাচীন বলিয়া ব্ৰহ্ম। ভাল, সর্ব পদার্থের ব্ৰহ্মরূপতা হয় কি প্রকারে ? এতদ্যুত্তরে বলিতেছেন-যেহেতু "তজ্জলান” তেজঃ, জল ও পৃথিবীক্রমে সমস্তই সেই ব্ৰহ্ম হইতে জাত , অতএব তজ্জ ; সেইরূপ সেই উৎপত্তিক্রমেরই বিপরীতভাবে সেই ব্ৰহ্মেই লীন হয়, অৰ্থাৎ তৎস্বরূপে মিলিত হয়, এই জন্য তল্ল; এইরূপ স্থিতিকালেও তাহাতেই প্ৰাণন বা চেষ্টা করে, এইরূপ কালত্ৰয়ই সমানভাবে ব্ৰহ্মাত্মক ; কারণ, তদ্ভিন্নরূপে জগতের, প্রতীতি হয় না। অতএব, নিশ্চয়ই এই জগৎ তৎস্বরূপ। যেরূপ এই জগতের সেই এক,অদ্বিতীয় ব্ৰহ্মাত্মতা সিদ্ধ হইতে পারে। যেহেতু এ সমস্তই ব্ৰহ্ম; অতএব, শান্ত-রাগদ্বেষাদিদোষরহিত, অর্থাৎ সংযত হইয়া সেই যে সর্বাত্মক ব্ৰহ্ম, তাঁহাকে বক্ষ্যমাণ গুণযোগে উপাসনা করিবে। কিরূপে উপাসনা করিবে?
ক্ৰতু করিবে; ক্ৰতু অর্থ-নিশ্চয় অধ্যবসায়, অর্থাৎ ইহা এইরূপই বটে, অন্যরূপ নহে, এই দৃঢ় বিশ্বাস; তাদৃশ ক্রতু করিবে ; পরবর্তী 'উপাসীত' পদের সহিত ইহার সম্বন্ধ। ক্রতুর অনুষ্ঠান দ্বারা কি প্রয়োজন সাধন করিতে হয় ? কি রূপেই বা ক্ৰতু করিতে হয় ? আর ক্রতুর অনুষ্ঠানই বা অভিপ্ৰেত প্ৰয়োজনের সাধক হয় কি প্রকারে ? এই বিষয় প্রতিপাদনার্থে 'অথ' ইত্যাদি গ্ৰন্থ আরব্ধ হইতেছে।
অথ খলু শব্দ হেত্বর্থে প্রযুক্ত, যেহেতু ক্ৰতুময়-ক্রতুবহুল, অর্থাৎ অধ্যবসায়াত্মক (সংকল্প-প্ৰধান) পুরুষ অর্থাৎ জীব ইহলোকে (বৰ্ত্তমান দেহে ) যথাক্রতু-যাহার যে প্রকার ক্রতু, সে যথাক্রতু-যেরূপ অধ্যবসায়-সম্পন্ন অর্থাৎ যে প্রকার নিশ্চয়বান হয়। এই দেহ হইতে প্ৰয়াণ করিয়া-মরিয়া সেইরূপ হয়; অর্থাৎ স্বকৃত ক্রতুর অনুরূপ ফলভাগী হইয়া থাকে । "জীব দেহান্তকালে যে যে বিষয় স্মরণ করত কলেবর পরিত্যাগ করে, হে কৌন্তেয়, সর্বদা তদ্ভাবে ভাবিত ( সেই চিন্তায় তন্ময়) থাকায় মৃত্যুর পর সেই সেই পদার্থকেই প্ৰাপ্ত হয়"- ইত্যাদি শাস্ত্ৰ হইতেও ইহা এইরূপ জানা যায়। যেহেতু এই প্রকার ব্যবস্থা শাস্ত্রদৃষ্ট, অতএব, সেই পুরুষ এই প্রকার অবগত হইয়া-আমরা যাদৃশ ক্রতুর কথা বলিব, তাদৃশ ক্ৰতু করিবে। যেহেতু শাস্ত্রের প্রামাণ্যানুসারেই ক্রতুর অনুরূপ এইপ্রকার ফলনিষ্পত্তি উপপন্ন হইতেছে, অতএব, তথাবিধ ক্রতু (উপাসনা) অবশ্য কৰ্ত্তব্য।
No comments:
Post a Comment