Monday, 29 July 2019

উপাসকগণের জন্য অসীম পরমেশ্বর বিশেষ বিশেষরূপে অভিব্যক্ত হনঃ-


প্রশ্ন এই, পরমাত্মা ব্রহ্ম নির্গুণ, অরূপ, বিভু বিশ্বব্যাপক; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ঠিক এর বিপরীত; তিনি সগুণ, তাঁর শরীর দৃশ্য, মথুরা, গোকুল, বৃন্দাবনাদি স্থানের একাংশে তাঁর স্থিতি, প্রাকৃত ব্যক্তির ন্যায় তাঁর অনুরাগ ক্রোধ বর্তমান, তিনি পরমাত্মা হবেন কিরূপে?

তদুত্তরে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য প্রবোধসুধাকরে বলেছেনঅপর সকল দৃশ্যপদার্থই এই চক্ষু দ্বারা দৃশ্য হয়ে থাকে, কিন্তু ভগবান্ এই চক্ষু দ্বারা দৃষ্ট হন না, তিনি জ্ঞাননেত্রে দৃশ্য। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ প্রদর্শনকালে অর্জুনকে যে দিব্যচক্ষু প্রদান করেছিলেন, তা হতেই নরহরির অদৃশ্যতা সিদ্ধ হয়। কিন্তু তার প্রমাণ কোথায়? স্বয়ং ভগবান্ শ্রীগীতায় বলেছেন

তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা৷

দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্৷৷

-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১১/)

তুমি নিজের প্রাকৃত স্থূল চক্ষু দ্বারা আমার বিশ্বরূপ দর্শন করতে সমর্থ হবে না। তোমাকে অপ্রাকৃত জ্ঞানচক্ষু দিচ্ছি। এই দিব্যচক্ষু দ্বারা আমার অঘটনঘটনসামর্থ্যরূপ যোগ-শক্তি দর্শন কর।

যেমন সূর্যমণ্ডল গগনের এক অংশে গোলাকারে দৃশ্যমান হন, কিন্তু সমগ্র বিশ্বকেই প্রকাশিত করেন এবং সকল লোক তাঁকে নানাস্থানে এককালে দর্শন করে থাকে, সেরূপ যদুনাথ যদ্যপি সাকার এবং একদেশে অবস্থিত বলে প্রতীয়মান হন, তথাপি তিনি সর্বব্যাপক সচ্চিদানন্দস্বরূপ সর্বাত্মা। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এক হলেও যুগপৎ অনেক গোপিকার সহিত যুগলরূপে ক্রীড়া করেছিলেন। একই সূর্য, বহুস্থানস্থিত বহুলোকের যেরূপ যুগপৎ দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকেন, সেরূপ শ্রীকৃষ্ণ এক হয়েও যুগপৎ বিভিন্ন স্থানস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তির প্রত্যক্ষ হয়েছিলেন। রাসলীলায় প্রত্যেক গোপীই যে এক সময়ে শ্রীকৃষ্ণসঙ্গ সুখ লাভ করেছিলেন, এর প্রমাণ বিষ্ণুপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবতাদি গ্রন্থে রয়েছে। তাছাড়া বিদেহরাজ জনক এবং শ্রুতদেবনামক ব্রাহ্মণ নিজ নিজ গৃহে একই সময়ে তাঁর আতিথ্য সৎকার স্তব করে কৃতার্থ হয়েছিলেন। এই বিবরণ বিস্তৃতভাবে শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম স্কন্ধের ৮৬ অধ্যায়ে আছে।

পরমাত্মা অসীম হলেও উপাসকদিগের প্রতি কৃপা পরবশ হয়েই বিশেষ বিশেষরূপে প্রকাশিত হন। 'অতিমাত্রস্যাপি পরমেশ্বরস্য প্রাদেশমাত্রত্বমভিব্যক্তিনিমিত্তং স্যাত্৷ অভিব্যজ্যতে কিল প্রাদেশমাত্রপরিমাণঃ পরমেশ্বর উপাসকানাং কৃতে৷ প্রদেশবিশেষেষু বা হৃদযাদিষূপলব্ধিস্থানেষু বিশেষেণাভিব্যজ্যতে৷ অতঃ পরমেশ্বরেপি প্রাদেশমাত্রশ্রুতিরভিব্যক্তেরুপপদ্যত্।'-(ব্রহ্মসূত্র-..২৯,শাঙ্করভাষ্য) অর্থাৎ অতিমাত্র অসীমবিভু হলেও পরমেশ্বরের যে প্রাদেশমাত্রতা, তা অভিব্যক্তিরূপ নিমিত্তবশতঃ হবে। উপাসকগণের জন্য পরমেশ্বর প্রাদেশমাত্র পরিমাণযুক্তরূপে অভিব্যক্ত হন। অথবা হৃদয় প্রভৃতি উপলব্ধিস্থানভূত প্রদেশসকলে পরমেশ্বর বিশেষভাবে অভিব্যক্ত হন। অতএব অভিব্যক্ত হন বলে পরমেশ্বরেও প্রাদেশমাত্র শ্রুতি সঙ্গত।

ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ কুরুপাণ্ডবের সন্ধিস্থাপন-মানসে হস্তিনাপুরে গমন করলে, দূর্যোধন তাঁকে একাকী মনে করে কর্ণাদির মন্ত্রণানুসারে বন্ধন করবার আয়োজন করেন, তখন দুর্যোধন দেখলেনশ্রীকৃষ্ণের বিশাল দেহে যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণ, বলরাম, প্রদ্যুম্ন অস্ত্র-শস্ত্র-সমন্বিত সৈন্যসমেত যদুকুলের উপস্থিতি। এই বিবরণ মহাভারতের উদ্যোগপর্বের ১৩১ অধ্যায়ে রয়েছে। এইসব উদাহরণে দেখা যায়, একই শ্রীকৃষ্ণ যুগবৎ অনেকবৎ দৃষ্ট হয়েছেন, যা অপর কোন দৃশ্যমান পরিচ্ছিন্ন শরীরে নেই। শ্রীবৎস, যখন শ্রীকৃষ্ণকে বক্ষঃস্থলে আঘাত করেন, তখনও তিনি কি শ্রীকৃষ্ণের দ্বেষের পাত্র হয়েছিলেন? অসুর এবং অপর যারাই ভক্ত তাদের সমান ফল হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণের কেউই শত্রু নয়, কেউই মিত্র নয়। নরহরি যদুনাথ উত্তম-পথ-পার্শ্ববর্তী ফলবান্ বিটপীর তুল্য। তাই শত্রুমিত্রে সমান সদ্গতি দাতা শ্রীহরির অনুরাগ বিদ্বেষ কল্পনা করা অনুচিত। অতএব ভগবান্ শ্রীহরি কৃষ্ণ সাক্ষাৎ ঈশ্বর। সর্বভূতের অন্তর্য্যামী, সচ্চিদানন্দ, জ্ঞানস্বরূপ, প্রকৃতির অতীত বা তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ যে পরমাত্মা, তিনিই এই যদুকুলতিলক শ্রীকৃষ্ণ।

তথ্যসূত্রঃ-

১. ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত "প্রবোধসুধাকর"
২. ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।




No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...