‘ত্রয়ো ধর্মস্কন্ধা যজ্ঞোহধ্যয়নং দানমিতি প্রথমস্তপ এব দ্বিতীয়ো ব্রহ্মচার্যাচার্যকুলবাসী, তৃতীয়োহত্যন্তম্ আত্মানম্ আচার্যকুলে অবসাদযন্ । সর্ব এতে পুণ্যলোকা ভবন্তি ব্রহ্মসংস্থোহমৃতত্বমেতি’।। -(সামবেদীয় ছান্দোগ্যোপনিষদ্-২/২৩/১)।
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ওঙ্কারের উপাসনা বিধানের উদ্দেশ্যে “ত্ৰয়ঃ ধৰ্ম্মস্কন্ধাঃ” ইত্যাদি গ্ৰন্থ আরব্ধ হইতেছে। এরূপ মনে করা উচিত হয় না যে, কেবল সামাবয়বভুত উদগীথাদিস্বরূপ ওঙ্কারের উপাসনা হইতে যে ফল লাভ করা যায়, ইহা হইতেও সেই ফলই প্ৰাপ্ত হওয়া যায় ; তবে কি ? না-সমস্ত সামোপসনা ও সমস্ত কৰ্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা যে অমৃতত্ব ফল লাভ করা যায় না ; সেই অমৃতত্ব-প্রাপ্তিরূপ ফলটি একমাত্র এই ওঙ্কারোপাসনা হইতেই লব্ধ হয়। তাহার প্রশংসা জ্ঞাপনার্থই সামোপাসনা-প্রকরণে তাহার উপন্যাস করা হইয়াছে।
“ত্ৰয়ঃ” অর্থ-ত্রিসংখ্যক ; ধৰ্ম্মস্কন্ধ অর্থ-ধৰ্ম্মের বিভাগ ; তাহারা কি কি ? এই আকাঙক্ষায় বলিতেছেন, যজ্ঞ-অগ্নিহোত্ৰপ্রভৃতি, অধ্যয়ন-নিয়ম পূর্বক ঋক্ প্রভৃতি বিদ্যার অভ্যাস; দান-বেদীর বাহিরে অর্থাৎ যজ্ঞভিন্ন সময়ে যে, যাচকগণকে যথাশক্তি দ্রব্য প্ৰদান করা; ইহাই প্রথম ধৰ্ম্মস্কন্ধ; ইহা গৃহস্থে আশ্রিত বলিয়া, এতৎ-নিষ্পাদক গৃহস্থের সহযোগে নির্দিষ্ট হইতেছে। তপস্যাই দ্বিতীয় (ধৰ্ম্মস্কন্ধ); “তপঃ’ অর্থ- কৃচ্ছ অর্থাৎ প্রাজাপত্য ব্ৰতের অপর নাম কৃচ্ছ, তাছাড়া ক্লেশসাধ্য ব্ৰতমাত্রকেও কৃচ্ছ বলে, চান্দ্ৰায়ণ প্রভৃতি ব্রত; কেবল নিয়মিতভাবে আশ্ৰম-ধৰ্ম্মমাত্রে অবস্থিত সেই তপঃসম্পন্ন – তাপস কিংবা পরিব্রাজকই (তপঃ শব্দে বুঝিতে হইবে, কিন্তু) একেবারে ব্ৰহ্মসংস্থ, অর্থাৎ ব্ৰহ্মনিষ্ঠ অর্থনহে ; কেন না, ব্ৰহ্মসংস্থের সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবেই অমৃতত্ব-ফলের উল্লেখ রহিয়াছে ; অতএব ইহাই দ্বিতীয় ধৰ্ম্মস্কন্ধ। আচাৰ্য্যকুলে (গুরুগৃহে) বাস করা যাহার স্বভাব, সেই আচাৰ্যকুলাবাসী এবং আচাৰ্য্যকুলেই অত্যন্ত অর্থাৎ যাবজ্জীবন নিয়মপূর্বক আপনার অবসাদনকারী অর্থাৎ দেহক্ষয়কারী (নৈষ্ঠিক) ব্ৰহ্মচারী তৃতীয় ধৰ্ম্মস্কন্ধ। এখানে “অত্যন্তং” ইত্যাদি বিশেষণ হইতে, প্ৰতীতি হইতেছে যে, এই ব্ৰহ্মচারী ‘নৈষ্ঠিক” ব্ৰহ্মচারী। কেননা, “উপকুর্ব্বাণের যে ব্ৰহ্মচৰ্য্য, তাহা কেবল বেদশিক্ষার্থ কিন্তু তাহা দ্বারা কোনও পুণ্যলোক লাভ হয় না। ব্রহ্মচারী দুই প্ৰকার-(১) উপকুৰ্ব্বাণ, (২) নৈষ্ঠিক। তন্মধ্যে যাঁহারা উপনয়নের পর দ্বাদশ বৎসর কাল ব্ৰহ্মচৰ্য্যপালন করিয়া-গুরুগৃহে বাস, গুরুশুশ্রুষা ও বেদবিদ্যাদি শিক্ষা করিয়া গুরুর অনুমতিগ্রহণপূর্বক সমাবৰ্ত্তন করে-গৃহে প্ৰত্যাগমনপূর্বক দারপরিগ্রহ করে তাঁহারা উপকুৰ্ব্বাণ ব্রহ্মচারী। আর যাঁহারা যাবজ্জীবন নিষ্ঠাপূর্ব্বক ব্রহ্মচর্য পালন করে অর্থাৎ সমাবৰ্ত্তনপূর্বক আর গৃহাশ্রমে প্রবেশ করে না, তাহাঁরা নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী।
ইহারা সকলেই অর্থাৎ উক্ত তিনপ্রকার আশ্রমীই উক্তপ্রকার ধৰ্ম্ম দ্বারা পুণ্যলোকভাগী হয়, অর্থাৎ, যাহাঁদের লোক (ভোগস্থান) পুণ্য (পবিত্র), তাহারা ‘পুণ্যলোক” পদবাচ্য। উক্ত আশ্রমিগণ সকলেই ঐ রূপ পুণ্যলোকগামী হইয়া থাকেন। উক্ত স্কন্ধ ত্ৰয়ের মধ্যে অনুক্ত অবশিষ্ট এবং (উক্ত স্কন্ধ ক্রয়াপেক্ষা) চতুর্থ পরিব্রাজকই (সন্ন্যাসীই এখানে) “ব্ৰহ্মসংস্থ’ শব্দের অর্থ, অর্থাৎ সেই পরিব্রাজকই সম্পূর্ণরূপে ব্ৰহ্মেতে অবস্থিত থাকেন, তজ্জন্য ঐ রূপ স্বৰ্গাদি পুণ্যলোক হইতে ভিন্নপ্রকার আত্যন্তিক অমৃতত্ব প্ৰাপ্ত হন ; কিন্তু, দেবগণের ন্যায় আপেক্ষিক (প্ৰলয়কাল পৰ্য্যন্ত জীবিত থাকারূপ) অমৃতত্ব নহে। অভিপ্ৰায় এই যে, এই অমৃতত্ব যদি পুণ্যলোকেরই উৎকৃষ্টাবস্থা হইত, তাহা হইলে কখনই তাহাকে পুণ্যলোক হইতে পৃথক করিয়া নির্দেশ করিতেন না।
প্ৰণবোপাসনার প্রশংসাৰ্থ এখানে আশ্রমগত ধৰ্ম্ম-ফলের উল্লেখ করা হইয়াছে মাত্ৰ, কিন্তু প্ৰকৃতপক্ষে তাহাদের ঐরূপ ফলবিধানার্থ নহে। স্মৃতিশাস্ত্রে, যে সমস্ত আশ্রম-ফল প্ৰসিদ্ধ আছে, এখানে তৎসমুদয়েরই অনুবাদ করিয়া প্ৰণবপোসনার ফল যে অমৃতত্বপ্ৰাপ্তি, ইহা জ্ঞাপন করত প্রণবসেবারই স্তুতি করিতেছেন। ব্ৰহ্মের ‘প্রতীক’ বলিয়া এই প্রণবই সেই সত্যস্বরূপ পরব্রহ্ম। কঠোপনিষদেও “এই অক্ষরই (প্ৰণবই) ব্ৰহ্ম, এবং এই অক্ষরই পর, অর্থাৎ ব্ৰহ্মপ্রতীক বলিয়া সর্বশ্রেষ্ঠ”, এইরূপ কথা থাকায় প্ৰণবসেবায় যে, অমৃতত্ব ফল প্ৰাপ্তি, তাহা যুক্তিযুক্তই বটে৷
No comments:
Post a Comment