‘কর্ম্মযোগ’
অর্জ্জুন উবাচ।
জ্যায়সী চেৎ কর্ম্মণস্তে
মতা বুদ্ধির্জনার্দ্দন।
তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব || ১ ||
তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব || ১ ||
ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং
মোহয়সীব মে।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ || ২ ||
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ || ২ ||
অর্জুন জিজ্ঞাসা
করিলেন -
হে জনার্দ্দন! যদি তোমার মতে কর্ম্ম হইতে জ্ঞান
শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব! আমাকে এই ক্রুর হিংসাত্মক কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ? ব্যামিশ্র
(সন্দেহজনক) বাক্যের দ্বারা আমার যেন বুদ্ধিকে মোহিত করিতেছ। অতএব যাহার দ্বারা আমি
শ্রেয় প্রাপ্ত হইব, সেই একই (এক প্রকার নিষ্ঠাই) আমাকে নিশ্চিত করিয়া বলিয়া দাও।
শ্রীভগবানুবাচ।
লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা
পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্ || ৩ ||
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্ || ৩ ||
অর্জ্জুনের প্রশ্নের প্রতিবচনে শ্রীভগবান বলিতেছেন-
হে অনঘ (নিষ্পাপ)! ইহলোকে শাস্ত্রানুষ্ঠানে অধিকৃতগণের দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে, ইহা পুরাকালে
অর্থাৎ সৃষ্টির প্রাক্ কালে প্রজা সৃষ্টি করিয়া তাহাদের অভ্যুদয়-নিঃশ্রেয়স-প্রাপ্তিসাধন
নিবৃত্তি ও প্রবৃত্তিমূলক বেদার্থ সম্প্রদায়ের আবিষ্কর্তা আমাকর্তৃক অর্থাৎ সর্ব্বজ্ঞ
ঈশ্বর কর্তৃক কথিত হইয়াছে। অর্থাৎ আত্ম-অনাত্ম-বিষয়-বিবেক-জ্ঞানবান, ব্রহ্মচর্য আশ্রম
হইতে যাহারা কৃতসন্ন্যাসী, বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিত অর্থ, পরমহংস পরিব্রাজক এবং ব্রহ্মে
অবস্থিত যাহারা সেই সাংখ্যদিগের নিষ্ঠা হইল জ্ঞানযোগ এবং যে যোগীদিগের নিষ্কামভাবে
কর্ম্ম করাই যোগ তাহাদের নিষ্ঠা কর্ম্মযোগ বলিয়াছি।
ন কর্ম্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্ম্যং
পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সন্ন্যাসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি || ৪ ||
ন চ সন্ন্যাসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি || ৪ ||
কর্ম্মনিষ্ঠা চিত্তশুদ্ধি
দ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠা বা পুরুষার্থের সাধক হয়। কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু বলিয়া পরতন্ত্রভাবে
পুরুষার্থের কারণ হয়, স্বতন্ত্রভাবে নহে। এই অর্থ দেখাইবার জন্য ভগবান বলিতেছেন- সত্ত্বশুদ্ধি
ও জ্ঞানোৎপত্তিদ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু যজ্ঞাদি কর্ম্মসকলের অনারম্ভ অর্থাৎ প্রারম্ভ
না করিয়া পুরুষ ইহজন্মে বা জন্মান্তরে নৈষ্কর্ম্যভাব অর্থাৎ কর্ম্মশুন্যতা ও নিষ্ক্রিয়
আত্ম-স্বরূপে অবস্থিতি প্রাপ্ত হয় না। আবার কেবলমাত্র সন্ন্যাস অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য কর্ম্মত্যাগ
হইতে সিদ্ধি অর্থাৎ নৈষ্কর্ম্যলক্ষণা জ্ঞানযোগনিষ্ঠা সম্যক্ রূপে অধিগত হয় না। শ্রুতিতেও
বলা হইতেছে-“এই আত্মাকে ব্রাহ্মণেরা বেদাধ্যয়ন এবং যজ্ঞের দ্বারা জানিতে ইচ্ছা করেন।”-(বৃহদারণ্যক
উপনিষদ-৪।৪।২২)
মহাভারতেও অন্যত্র
বলা হইতেছে-“পুরুষের পাপের ক্ষয় হইলে জ্ঞান অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি দ্বারা জ্ঞানাভ্যাস
যোগ্যতা উৎপত্তি হয়।”-(শান্তিপর্ব-২০৪।৮)
ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু
তিষ্ঠত্যকর্ম্মকৃৎ ।
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
পুনশ্চ কি কারণে জ্ঞানরহিত কর্ম্মসন্ন্যাস মাত্র
হইতে নৈষ্কর্ম্যলক্ষণ সিদ্ধি পুরুষ অধিগত করিতে পারেনা, সেই প্রসঙ্গে ভগবান বলিতেছেন-যেহেতু
কেহই কদাচিৎ ক্ষণকালও কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পারে না। কেননা প্রকৃতিজ অর্থাৎ প্রকৃতিজাত
সত্ত্বরজস্তমাদি গুণের দ্বারা অবশ হইয়া সকল অজ্ঞানীরাই কর্ম্ম করিয়া থাকে।
কর্ম্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য
য আস্তে মনসা স্মরণ্ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে || ৬ ||
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে || ৬ ||
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি
মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জ্জুন।
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে || ৭ ||
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে || ৭ ||
যিনি অনাত্মজ্ঞ তিনি যদি শাস্ত্রাদিষ্ট কর্ম্ম
না করে তাহইলে তাহা অসৎ, এই প্রসঙ্গে বলা হইতেছে-যে বিমূঢ়াত্মা অর্থাৎ বিমূঢ় অন্তঃকরণ
যাহার, মনেতে ইন্দ্রিয়-বিষয় সকল স্মরণ রাখিয়া, কেবল হস্তাদি কর্ম্মেন্দ্রিয় সংযম করিয়া
অবস্থিতি করে, সে মিথ্যাচারী বা কপট পাপাচারী। পুনশ্চ হে অর্জ্জুন! যে কর্ম্মেতে অধিকারী অজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল মনের দ্বারা নিয়মিত
করিয়া, অনাসক্ত হইয়া বাক্ পাণি প্রভৃতি কর্ম্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্ম্মযোগের অভ্যাস
করে, সে পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী হইতে বিশিষ্ট।
নিয়তং
কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যকর্ম্মণঃ ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেধকর্ম্মণঃ || ৮ ||
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেধকর্ম্মণঃ || ৮ ||
যেহেতু অনাত্মজ্ঞ অজ্ঞানীর পক্ষে
কর্ম্ম করা ভাল সেইজন্য-তুমি নিয়ত তথা নিত্য কর্ম্ম করিবে অর্থাৎ যে সকল কর্ম্মের ফল-অর্থে
কোন শ্রুতির আদেশ দেখা যায় না, ঐ সকল কর্ম্মে যাহারা অধিকৃত তাহাদের নিকট ঐসকল কর্ম্ম
নিত্য কর্ম্ম। কারণ ভয় আলস্য বশতঃ কর্ম্মশূন্যতা হইতে কর্ম্ম অধিক ফলদ। কর্ম্মশূন্যতায়
তোমার শরীরযাত্রা অর্থাৎ শরীরস্থিতিও সিদ্ধ হইবে না।
যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণোহন্যত্র
লোকোহয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর || ৯ ||
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর || ৯ ||
যদি তুমি মনে কর বন্ধনের হেতু বলিয়া কর্ম্ম কর্ত্তব্য
নহে তবে তাহা ভূল। কারণ যজ্ঞার্থ যে কর্ম্ম অর্থাৎ ‘যজ্ঞই
বিষ্ণু’-(তৈত্তিরীয় সংহিতা ১।৭।৪) এইরূপ শ্রুতিহেতু ঈশ্বরার্থে যে কর্ম্ম, তদ্ভিন্ন
অন্যত্র কর্ম্ম ইহলোকে বন্ধনের কারণ হয়। হে কৌন্তেয়! তুমি সেই জন্য ঈশ্বরার্থে মুক্তসঙ্গ
অর্থাৎ কর্ম্মফলসঙ্গবর্জ্জিত হইয়া, কর্ম্ম সম্যক্ রূপে আচরণ কর।
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা
পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ || ১০ ||
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ || ১০ ||
এই সকল কারণে অজ্ঞানী কর্ম্মাধিকারীদের কর্ম্ম
কর্ত্তব্য- যজ্ঞের সহিত ত্রিবর্ণাদি প্রজাসৃষ্টি করিয়া পুরাকালে প্রজাপতি অর্থাৎ প্রজাগণের
স্রষ্টা বলিয়াছিলেন, ‘এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা প্রসব তথা উৎপত্তি বা বর্দ্ধিত হও। ইষ্ট
তথা অভিপ্রেত কাম্যফল বিশেষ সমূহ, যাহা হইতে লোকে দোহন করে তাহাই কামধেনু স্বরূপ ইষ্টকামধুক।
এই যজ্ঞ তোমাদিগের ইষ্টকামধুক হোক।’
দেবান্
ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ || ১১ ||
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ || ১১ ||
যজ্ঞের দ্বারা দেবোপসনার প্রয়োজন
কি- তোমরা ইন্দ্রাদি দেবসকলকে এই যজ্ঞের দ্বারা ভাবনা অর্থাৎ বর্দ্ধিত কর; ঐ দেবগণও
তোমাদিগকে বৃষ্টি প্রভৃতির দ্বারা বর্দ্ধিত করুন। এইরূপে পরস্পর একে অন্যকে ভাবনা তথা
বর্দ্ধিত করায় মোক্ষলক্ষণ জ্ঞানপ্রাপ্তিক্রমে স্বর্গ বা পরম শ্রেয়ঃ প্রাপ্ত হইবে।
ইষ্টান্
ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যতে যজ্ঞভাবিতাঃ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্ক্তে স্তেন এব সঃ || ১২ ||
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্ক্তে স্তেন এব সঃ || ১২ ||
যজ্ঞভাবিত হইয়া অর্থাৎ যজ্ঞের
দ্বারা বর্দ্ধিত বা তোষিত হইয়া তোমাদের যাঁহার যেমন অভিরূচি তথা স্ত্রী, পুত্র, পশু
প্রভৃতি ইষ্ট অর্থাৎ অভিপ্রেত ভোগ্যসকল দেবগণ তোমাদের বিতরণ করিবেন। সেই দেবতাদের দ্বারা
দত্ত ভোগসকল তাঁহাদিগকে না দিয়া অর্থাৎ তাহাঁদের ঋণ পরিশোধ না করিয়া যাঁহারা ভোগ করে
অর্থাৎ স্বদেহেন্দ্রিয়াদির যাঁহারা তর্পণ করে তাহারাই তস্কর অর্থাৎ চোর; কারণ সে দেবাদির
নিজস্ব অপহারী।
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ
সন্তো মুচ্যন্তে সর্ব্বকিল্বিষৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ || ১৩ ||
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ || ১৩ ||
পরন্তু দেবযজ্ঞাদি সম্পন্ন করিয়া
তাহার উচ্ছিষ্ট বা অবশিষ্ট অমৃতাখ্য অশন বা অন্ন যাঁহারা ভোজন করিয়া থাকেন তাঁহারা
যজ্ঞাশিষ্টাশী সন্ত অর্থাৎ সাধু, তাঁহারা মনুস্মৃতিতে উল্লেখিত চুল্লী প্রভৃতি মার্জনাদি
হেতু পঞ্চসূনাজনিত অজ্ঞাতসারে কৃত পাপ এবং তাছাড়া প্রমাদকৃত হিংসাজনিত অন্য সমস্তপাপ
হইতেও মুক্ত হন। কিন্তু
যেসব উদরপরায়ণ লোক কেবল নিজেদের জন্যই অন্ন পাকক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া থাকে সেই আত্মম্ভরেরাই
স্বয়ং পাপী, আর পাপই ভক্ষণ করিয়া থাকে।
অন্নাদ্ভবন্তি
ভূতানি পর্জ্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ || ১৪ ||
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ || ১৪ ||
এইজন্য অধিকারীর জগচ্চক্রপ্রবৃত্তিরহেতু কর্ম্ম
কর্ত্তব্য। কেননা ভুক্ত অন্ন হইতে রক্তরেত পরিণামহেতু ‘ভূতসকল জাত হয়’-এ প্রত্যক্ষ।
পর্জ্জন্য অর্থাৎ বৃষ্টি হইতে অন্নের সৃষ্টি; আবার যজ্ঞ হইতে পর্জ্জন্য হয়, যথা- ‘অগ্নিতে
বিধিপূর্বক প্রদত্ত আহুতি সূর্য্যে স্থিত হয়, পরে সূর্য্য হইতে ক্রমে মেঘ হইয়া বৃষ্টি
হয়, বৃষ্টি হইতে অন্ন হয়, আর অন্ন হইতে প্রজা উৎপন্ন হয়’-এইরূপ মনুস্মৃতিতে (৩।৭৬) এ আছে। অপূর্ব
কর্ম্মফল শক্তিবিশিষ্ট যজ্ঞ কর্ম্মসমুদ্ভব অর্থাৎ ঋত্বিকগণ এবং যজমানের মধ্যে যে যাগাদি
ব্যাপার চলে তাই কর্ম্ম এবং এই কর্ম্ম হইতে অপূর্ব ফলবিশিষ্ট যজ্ঞের সমুদ্ভব হয়।
কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি
ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ || ১৫ ||
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ || ১৫ ||
কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভব; এইক্ষেত্রে ব্রহ্ম শব্দের
অর্থ বেদ, সেই বেদ যাহার উদ্ভব অর্থাৎ কারণ, তাহাকেই ব্রহ্মোদ্ভব বলিয়া জানিবে অর্থাৎ
কর্ম্ম বেদ হইতে উদ্ভূত। সেই বেদাখ্য ব্রহ্ম অক্ষর পরমাত্মা ব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভব অর্থাৎ
উৎপত্তির হেতু বলিয়া জানিবে; যেহেতু সাক্ষাৎ পরমাত্মাখ্য অক্ষর হইতে পুরুষ-নিঃশ্বাসবৎ
বেদরূপ ব্রহ্ম সমুদ্ভূত হইয়াছেন সেইজন্য বেদের সর্ব্বজ্ঞান প্রকাশকত্ব হেতু তাহা সর্ব্বগত
এবং যজ্ঞবিধিতে প্রাধান্যহেতু এই সর্ব্বগত বেদ নিত্য অর্থাৎ সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।
এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ
যঃ৷
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি || ১৬ ||
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি || ১৬ ||
ইহলোকে যে ব্যক্তি কর্ম্মে অধিকৃত হইয়া এইরূপ ঈশ্বর
কর্তৃক বেদযজ্ঞপূর্ব্বক প্রবর্ত্তিত জগৎচক্রের অনুবর্তন না করে সে অঘায়ু অর্থৎ পাপ-জীবন
এবং ইন্দ্রিয়ারাম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাঁহার বিষয় সকলে আরাম বা রমণক্রীড়া হয়
সেই ইন্দ্রিয়ারাম। হে পার্থ, সে মোঘ অর্থাৎ বৃথা জীবন ধারণ করে। সেইজন্য যাহারা অজ্ঞানী
কর্ম্মাধিকারী তাহাদের পক্ষে কর্ম্মই কর্ত্তব্য-এই হচ্ছে আলোচ্য প্রকরণের সিদ্ধান্ত।
যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ
মানবঃ।
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে || ১৭ ||
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে || ১৭ ||
কিন্তু যে সাংখ্যযোগী আত্মজ্ঞাননিষ্ঠ আত্মরতি অর্থাৎ
যাঁহার আত্মাতেই প্রীতি, বিষয়ে নহে তিনি আত্মরতি হন এবং যিনি আত্মতৃপ্ত অর্থাৎ আত্মার
দ্বারা তৃপ্ত, পরন্তু অন্নরসাদির দ্বারা নহে, সেই মানব সন্ন্যাসী আত্মাতেই সন্তুষ্ট।
বাহ্যার্থ লাভে সকলেরই সন্তোষ হইয়া থাকে, কিন্তু সে বাহ্য সন্তোষকে অপেক্ষা না করে
যিনি আত্মসন্তুষ্ট অর্থাৎ অন্য সমস্ত বিষয়ে বীততৃষ্ণ-এইরূপ। যিনি ইদৃশ আত্মবিৎ তাঁহার
কার্য্য অর্থাৎ করণীয় কিছুই বিদমান নাই।
নৈব তস্য
কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন।
ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ || ১৮ ||
ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ || ১৮ ||
এই পরমাত্মাতে প্রীতিযুক্ত পুরুষের
কৃতকর্ম্মের কোন প্রয়োজন নাই; এবং জীবন্মুক্তের ইহলোকে কিছু না করিলে কোনরূপ কোন প্রত্যবায়
প্রাপ্তি বা আত্মহানি অর্থাৎ নরকাদি অনিষ্ট-লক্ষণ ত্রুটি হয় না। এবং সর্ব্বভূতে অর্থাৎ
ব্রহ্মা হইতে স্থাবর পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতে তাঁহার কোনরূপ অর্থ-ব্যপাশ্রয় হয় না। ফল প্রয়োজন নিমিত্ত যে ক্রিয়া-সাধ্য-আশ্রয়
তাহাকে অর্থ-ব্যপাশ্রয়
বলে। আত্মজ্ঞানীর পক্ষে এমন কোনও ভূতবিশেষ নাই যাহাঁকে আশ্রয় করিয়া কোন সাধ্য অর্থ
তাঁহার আছে, যাহার জন্য তাঁহার কাছে ফলার্থে অনুষ্ঠেয় কোন ক্রিয়া থাকিবে।
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য্যং
কর্ম্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম্ম পরমাপ্লোতি পুরুষঃ || ১৯ ||
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম্ম পরমাপ্লোতি পুরুষঃ || ১৯ ||
পরন্তু তুমি এই ‘সর্বতঃ সংপ্লুতোদকস্থানীয়’- (ভগবদ্গীতা-২।৪৬)
সম্যগ্ দর্শনে অবস্থিত নও অর্থাৎ এখনও জ্ঞানযোগারূঢ় হও নাই- সেইজন্য অসক্ত অর্থাৎ সঙ্গবর্জ্জিত
হইয়া সতত তথা সর্বদা কার্য্য অর্থাৎ কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্যক্ রূপে আচরণ করিবে। যেহেতু
অসক্ত হইয়া ঈশ্বরার্থে কর্ম্ম করিলে পুরুষ চিত্তশুদ্ধি দ্বারা পরম মোক্ষ প্রাপ্ত হয়।
কর্ম্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা
জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্ত্তুমর্হসি || ২০ ||
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্ত্তুমর্হসি || ২০ ||
যেহেতু পূর্বে বিদ্বান জনকাদি ক্ষত্রিয়েরা সম্যগদর্শী
হইয়াও প্রারব্ধ কর্ম্মক্ষয়ের জন্য লোককল্যাণার্থ কর্ম্মের সহিত অর্থাৎ কর্ম্মত্যাগ
না করিয়া সংসিদ্ধি রূপ মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। প্রারব্ধ কর্ম্মায়ত্ত
তুমিও লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া অর্থাৎ লোকের উন্মার্গ প্রবৃত্তি নিবারণরূপ
প্রয়োজন সম্যক্ রূপ দর্শন করিয়া কর্ম্ম কর।
(শাঙ্করভাষ্যের ‘প্রারব্ধ’ বিষয়ে টীকা- কর্ম্মসংস্কার ত্রিবিধ-১.সঞ্চিত,
২.ক্রিয়মান, ৩.প্রারব্ধ। ব্রহ্মসূত্রের ৪।১।১৫,১৯ তে বর্ণিত আছে-‘জীবন্মুক্ত ব্রহ্মজ্ঞানীর
জ্ঞানের দ্বারা সঞ্চিত অর্থাৎ যাহা এখনও ফল দেয় নাই এবং ক্রিয়মান কর্ম্মফলই বিনষ্ট
হয়। কিন্তু প্রারব্ধ অর্থাৎ যাহা ফল প্রদান করিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং যাহা এই দেহকে
সৃষ্টি করিয়া মনুষ্যকে জ্ঞানলাভে উন্নীত করিয়াছে, জ্ঞানের দ্বারা এই প্রারব্ধের বিনষ্ট
হয় না। এই প্রারব্ধ কর্ম্মফল তাহাকে মৃত্য পর্য্যন্ত ভোগ করিতে হয়। ভোগের দ্বারা পাপ
এবং পূণ্য উভয়প্রকার প্রারব্ধ ফল ক্ষয় করিয়া মৃত্যুর পরই ব্রহ্মজ্ঞ বিদেহমুক্তি অর্থাৎ
ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হন। ছান্দোগ্যের ৬।১৪।২ শ্রুতি তার প্রমাণ।’)
যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো
জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে || ২১ ||
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে || ২১ ||
লোকশিক্ষা কে দেবার উপযুক্ত এবং কিরূপে দেয়া উচিত
তাই বলা হইতেছে- যে যে বিষয়ে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ প্রধান ব্যাক্তিরা যে যে কর্ম্ম আচরণ করেন,
ইতর অর্থাৎ অপরাপর লোকেও সেই সেই কর্ম্মের অনুগত হয়। এবং সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি লৌকিক
বা বৈদিক যে কোনও তত্ত্ব প্রমাণ করেন, লোকে তাহার অনুসরণ করে অর্থাৎ কার্য্যের দ্বারা
তাই তাঁহারা প্রমাণ করিয়া থাকে।
ন মে পার্থাস্তি
কর্ত্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত্ত এব চ কর্ম্মণি || ২২ ||
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত্ত এব চ কর্ম্মণি || ২২ ||
যদি তোমার এই লোকসংগ্রহ কর্ত্তব্যতাতে কোন শঙ্কা
হয়, তাহলে আমাকে কেন দেখছ না?- হে পার্থ, আমার ত্রিলোকে কিছুমাত্রও
কর্ত্তব্য বিদ্যমান নাই। কেন?-কারণ আমার কিছু অপ্রাপ্ত বা প্রাপনীয় নাই; তথাপি আমি
কর্ম্মে বর্তমান।
যদি হ্যহং
ন বর্ত্তেয়ং জাতু কর্ম্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ || ২৩ ||
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ || ২৩ ||
যদি আমি কদাচিৎ অতন্দ্রিত অর্থাৎ অনলসভাবে কর্ম্মে
প্রবর্তিত না থাকি, লোকে যে আমাকে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সৎপুরুষ বলিয়া জানে, হে পার্থ! সেই
আমার কর্ম্মহীন মার্গ মনুষ্যেরা সর্ব্বপ্রকারে অনুসরণ করিবে।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্য্যাং
কর্ম্ম চেদহম্।
সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪ ||
সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪ ||
ভগবান্ যদি কর্ম্ম করে না দেখান তাহলে কি দোষ হইবে
তাহা বলা হইতেছে- যদি আমি কর্ম্ম না করি, লোকস্থিতি নিমিত্ত কর্ম্মের অভাব হেতু এই
সব লোক উচ্ছেদ বা বিনাশ প্রাপ্ত হইবে এবং আমি নিজেও সঙ্করের কর্ত্তা হইব এবং সেইকারণে
এই প্রজাদের অনুগ্রহের নিমিত্ত যে আমি তাহাদের উপহননই করিব এইরূপ অর্থ। এতদ্বারা এই
কার্য্য-আমি যে ঈশ্বর-আমার অনুরূপ হইবে না।
সক্তাঃ
কর্ম্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্ব্বন্তি ভারত।
কুর্য্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্ || ২৫ ||
কুর্য্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্ || ২৫ ||
পুনশ্চ যদি তুমি বা অন্য কেউ আমার মত নিজেকে কৃতার্থবুদ্ধি
ও আত্মবিদ্ মনে কর তাহা হইলে তোমার বা তাহার নিজকর্ত্তব্যের অভাব হইলেও পরানুগ্রহ করিবার
জন্য কর্ম্ম করা কর্ত্তব্য। কর্ম্মে আসক্ত অর্থাৎ ‘এই কর্ম্মের এই ফল আমার হইবে’ এইরূপ
কোন কোন অবিদ্বানেরা যেমন করিয়া থাকে, হে ভারত! আত্মবিৎ বিদ্বানেরা সেইরূপ অনাসক্তভাবে
কর্ম্ম করিবেন। লোকসংগ্রহ চিকীর্ষু হইয়া অর্থাৎ লোককল্যাণের ইচ্ছা করিয়া সেইসব আত্মবিদেরা
কিজন্য কর্ম্ম করেন শ্রবণ কর-
ন বুদ্ধিভেদং
জনয়েদজ্ঞানাং কর্ম্মসঙ্গিনাম্।
জোষয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ || ২৬ ||
জোষয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ || ২৬ ||
বুদ্ধিকে বিচলিত করিয়া দেয়ার নাম বুদ্ধিভেদ। ‘আমা
কর্তৃক এই কর্ত্তব্য, এই কর্ম্মের ফল ভোক্তব্য’, অজ্ঞানহেতু এইরূপ নিশ্চয়রূপ বুদ্ধির
চালন হইতেছে বুদ্ধিভেদ, তাহা উৎপাদন করা উচিত নহে। কাদের?–অজ্ঞ
অবিবেকী কর্ম্মাসক্তদের অর্থাৎ কর্ম্মে যাহারা আসক্ত বা আসঙ্গবান্ তাহারাই কর্ম্মসঙ্গী।
তাহলে কি করা উচিত?-বিদ্বান সমাহিত চিত্তে অবিদ্বানের জন্য শাস্ত্রবিহিত কর্ম্মসকল
নিজে আচরণ কোরে তাহাদের দ্বারা সকল কর্ম্ম করাইবেন।
প্রকৃতেঃ
ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্ম্মাণি সর্ব্বশঃ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে || ২৭ ||
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে || ২৭ ||
অবিদ্বান
অজ্ঞ কর্ম্মে কিরূপে আসক্ত হয়, ভগবান তাহাই বলিতেছেন-‘প্রকৃতির অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ
এবং তমঃগুণের সাম্যাবস্থার নাম প্রধান- এই প্রধান যখন ক্রিয়াশীল হয় তখন তাহাকে প্রকৃতি
বলে,- এই প্রকৃতির কার্য্য ও করণরূপ গুণসকলের বিকারের দ্বারা সর্ব্বপ্রকারে লৌকিক এবং
শাস্ত্রীয় কর্ম্মসকল ক্রিয়মান হয়। অহঙ্কার বিমূঢ়াত্মা অর্থাৎ কার্য্য (দেহ) করণ
(ইন্দ্রিয়) সংঘাত
বা সংযোগ হইতে যে আত্মপ্রত্যয় তাহাই অহঙ্কার, সেই অহঙ্কারের দ্বারা নানাবিধভাবে মূঢ়তা
প্রাপ্ত হইয়াছে যাহার আত্মা অর্থাৎ অন্তঃকরণ সে। কার্য্য-করণ-ধর্ম্মা বা কার্য্য-করণাভিমানী
অর্থাৎ কার্য্যরূপ দেহ এবং করণরূপ অন্তর ও বহিরিন্দ্রিয়ে অভিমানী, অবিদ্যা বা অবিবেকহেতু
কর্ম্মসকল আত্মাতে মনে করে অর্থাৎ মিথ্যারোপ কোরে সেই সেই কর্ম্মের ‘আমি কর্ত্তা’ এইরূপ
মনে করে।
(শাঙ্করভাষ্যের
কার্য্য-করণ বিষয়ে টীকাঃ- প্রকৃতিবিকারের কার্য্য অর্থাৎ দেহ হইতেছে-স্বেদজ, অন্ডজ,
উদ্ভিজ্জ এবং জরায়ুজ। এই সকল ভোগায়তন পঞ্চীকৃত স্থুলভূত নির্মিত। আর করণ হইতেছে- মন,
বুদ্ধি, অহঙ্কার, চিত্ত, পঞ্চপ্রাণ এবং দশইন্দ্রিয়।)
তত্ত্ববিত্তু
মহাবাহো গুণকর্ম্মবিভাগয়োঃ।
গুণা গুণেষু বর্ত্তন্তে ইতি মত্বা ন সজ্জতে || ২৮ ||
গুণা গুণেষু বর্ত্তন্তে ইতি মত্বা ন সজ্জতে || ২৮ ||
হে মহাবাহো! প্রকৃতির গুণকর্ম্মবিভাগের তত্ত্ব যে তত্ত্ববিদ জানেন, তাঁহারা বুঝেন যে, গুণসকল অর্থাৎ
করণাত্মক ইন্দ্রিয়সকলই গুণসমূহে অর্থাৎ তমঃগুণবিকার রূপরসাদি বিষয়সমূহে প্রবর্ত্তিত
হয়; আত্মা কখনও প্রবর্ত্তিত হন না। এইরূপ মনন করে তাঁহারা বিষয়ে বা কর্ম্মে আসক্ত হন
না।
প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়াঃ
সজ্জন্তে গুণকর্ম্মসু।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ || ২৯ ||
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ || ২৯ ||
প্রকৃতির গুণসকলের দ্বারা সম্যক্ মূঢ় অর্থাৎ সংমোহিত
পুরুষেরা ‘আমরা ফলের নিমিত্ত কর্ম্ম করছি’ মনে করে গুণকৃত কর্ম্মে আসক্ত হয়। সেই কর্ম্মফলাসক্তেরা
অল্পদর্শী, কারণ তাহারা কর্ম্মফল মাত্রই সর্ব্বস্ব এইরূপ দর্শন করে। সেই মন্দপ্রজ্ঞদের
আত্মবিৎ নিজে কখনও বিচালিত বা বুদ্ধিভেদ করিবেন না।
ময়ি সর্ব্বাণি
কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীর্নির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ || ৩০ ||
নিরাশীর্নির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ || ৩০ ||
পুনশ্চ কর্মাধিকারী অজ্ঞানী অথচ মুমুক্ষ ব্যক্তিদ্বারা
কিরপ কর্ম্ম কর্ত্তব্য বলা হইতেছে-‘আমি যে বাসুদেব পরমেশ্বর সর্বজ্ঞ সর্বাত্মা আমাতে
সর্ব্বকর্ম্মফল সন্ন্যাস অর্থাৎ নিক্ষেপ করিয়া যে অধ্যাত্মচিত্ত অর্থাৎ বিবেকবুদ্ধির
সহিত ‘আমি কর্ত্তা কিন্তু ঈশ্বরের নিমিত্ত ভৃত্যবৎ কর্ম্ম করিব’- এইরূপ বুদ্ধিদ্বারা
এবং সমস্ত আশা ত্যাগ করিয়া, নির্ম্মম হইয়া অর্থাৎ ‘তব’ ও ‘মম’ ভাব যাহার নির্গত হইয়া
গেছে সে নির্মম, এমন যে তুমি-বিগতজ্বর অর্থাৎ বিগত সন্তাপ বা বিগত শোক হইয়া হইয়া যুদ্ধ
কর।
যে মে
মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্ম্মভিঃ || ৩১ ||
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্ম্মভিঃ || ৩১ ||
এই যে অভিমত কর্ম্ম কর্ত্তব্য, যাহা প্রমাণের সহিত
বলা হইল, তাহা যথার্থ এই জেনে যে সকল মনুষ্য শ্রদ্ধাবান্
ও আমি যে গুরুস্বরূপ বাসুদেব আমাতে যাহারা অসূয়া করে না অর্থাৎ অসূয়াশূন্য হইয়া আমার
এই মতের নিত্য অনুবর্ত্তন করে, তাহারা ধর্ম্মাধর্ম্মাখ্য কর্ম্মসকল হইতে মুক্ত হয়।
যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি
মে মতম্।
সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ || ৩২ ||
সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ || ৩২ ||
যাহারা তদ্বিপরীত অর্থাৎ অসূয়াপরবশ হইয়া আমার এই
মতের অনুবর্ত্তন করে না, তাহাদিগকে সর্ব্বজ্ঞান বিষয়ে বিবিধরূপে মূঢ়, বিনষ্ট এবং অবিবেকী
বলিয়া জানিবে।
সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ
প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি || ৩৩ ||
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি || ৩৩ ||
পুনশ্চ কি জন্য তাহারা তোমার মতানুসরণ করিতেছেনা
না, পরধর্ম্মের অনুসরণ কোরে স্বধর্ম্মের অনুসরণ করিতেছেনা?
সেই তোমার প্রতিকূলাচরণকারীরা তোমার শাসন-অতিক্রম-দোষহেতু কেন ভয় পাইতেছে না? এই বিষয়ে
বলা হইতেছে-‘সকল প্রাণী
স্বীয়া বা স্বকীয়া অপরা প্রকৃতির সদৃশ অর্থাৎ অনুরূপ চেষ্টা করিয়া থাকে অর্থাৎ পূর্বকৃত ধর্ম-অধর্ম্ম
বা পুণ্য-পাপাদি সংস্কার বর্তমান জন্মাদিতে যাহা অভিব্যক্ত, উহার নাম প্রকৃতি। জ্ঞানবানও
তদনুরূপ চেষ্টা করিয়া থাকে তো মূর্খের আর কি কথা? সেইজন্য ভূত সকল অর্থাৎ লোকেরা স্ব
স্ব প্রকৃতির অনুপাতী কার্য্য করে, এতে আমার বা অন্যের নিষেধ তাহাদের আর কি করিবে?’
ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে
রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেত্তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ || ৩৪ ||
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেত্তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ || ৩৪ ||
যদি সকল
প্রাণীই স্বীয় প্রকৃতি সদৃশ চেষ্টা করে এবং জগতে যখন কেহ প্রকৃতিশূন্য নাই, তখন পুরুষকারের
বিষয়তা না থাকায় শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধরূপ প্রযত্নের আনর্থক্য প্রাপ্তিতে এই বলা হইতেছে-
প্রতি ইন্দ্রিয়ের অর্থে অর্থাৎ সকল ইন্দ্রিয়ের স্ব স্ব বিশিষ্ট শব্দাদি বিষয়রূপ অর্থ-ইষ্ট
হইলে তাহাতে যে রাগ এবং অনিষ্ট হইলে যে দ্বেষ; এইরূপ প্রতিইন্দ্রিয়ার্থে রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী।
শাস্ত্রার্থে প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে রাগদ্বেষের বশীভূত হওয়া উচিত নয়; যাহা পুরুষের
রাগদ্বেষ পুরঃসরা অপরা প্রকৃতি তিনি পুরুষকে স্বকার্য্যে প্রবর্ত্তিত করেন, তখন পুরুষের
স্বধর্ম অর্থা স্বীয় আত্মধর্ম পরিত্যাগ এবং পরধর্ম্ম অর্থাৎ প্রাকৃত ধর্ম্মানুষ্ঠান
হইয়া থাকে। সেইজন্য, সেই রাগদ্বেষের বশগামী হইও না; কেন না তাহারা তস্করের (চোরের) মত
পুরুষের পরিপন্থী বা শ্রেয়োমার্গের বিঘ্নকারক।
শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ
পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ || ৩৫ ||
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ || ৩৫ ||
এখন রাগদ্বেষপ্রযুক্ত মানব তো শাস্ত্রার্থকে অন্যভাবেও
মানে করিতে পারে এবং পরধর্ম অর্থাৎ প্রাকৃতধর্ম্মকে আত্মধর্ম্মত্বহেতু অনুষ্ঠেয় মনে
করিতে পারে? কিন্তু সেই মানাটা ভূল তাই বলিতেছেন- স্বধর্ম্ম অর্থাৎ আত্মধর্ম্ম
বিগুণ হইলেও তাহা সু-অনুষ্ঠিত পরধর্ম্ম অর্থাৎ সদ্ গুণের সহিত সম্পাদিত দেহগত জড়ধর্ম্ম
অপেক্ষা শ্রেয় অর্থাৎ প্রশংসনীয়। পরধর্ম্মে থেকে জীবনধারণ অপেক্ষা স্বধর্ম্মে থাকিয়া
নিধন বা মরণও ভাল। কেন?-নরকাদিলক্ষণ ভয় সমূহ আনয়ন করে বলিয়া পরধর্ম্ম অর্থাৎ দেহাত্মপরায়ণ
ভোগ-ধর্ম্ম ভয়াবহ।
অর্জ্জুন উবাচ।
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপঞ্চরতি
পুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ || ৩৬ ||
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ || ৩৬ ||
পরে অর্জ্জুন বলিতেছেন-
হে বার্ষ্ণেয় অর্থাৎ বৃষ্ণিকুল প্রসূত! কোন্ হেতুভূত
কারণের দ্বারা প্রেরিত হইয়া, রাজার দ্বারা যেমন ভৃত্য চালিত হয়, সেইরূপ এই পুরুষ নিজের
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাপকর্ম্ম আচরণ করে? অর্থাৎ বলপূর্ব্বক নিযুক্ত হয়, যেমন দৃষ্টান্তে
বলা হইয়াছে, রাজার দ্বারা বলপূর্ব্বক ভৃত্য নিযুক্ত হয়।
শ্রীভগবানুবাচ।
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ || ৩৭ ||
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ || ৩৭ ||
তুমি যে সর্ব্বানর্থকর বৈরীর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ,
তাহা শ্রবণ কর-
শ্রীভগবান
কহিলেন-‘এই কাম সর্ব্বলোক শত্রু, কারণ প্রাণিদের সর্ব্বানর্থ প্রাপ্তির নিমিত্ত। সেই
এই কাম যদি কোন কারণে প্রতিহত হয় তাহইলে ক্রোধরূপে পরিণত হয়, এইজন্য ক্রোধ ও কামই।
রজোগুণ হইতে সমুদ্ভব যাহার, সেই কাম রজোগুণসমুদ্ভব; অথবা রজোগুণের সম্যকরূপে উদ্ভবকারী
অর্থাৎ কাম প্রথমে উদ্ভুত হইয়া রজঃগুণকে প্রবর্তিত কোরে পরে পুরুষকে কর্ম্মে প্রবর্তিত
করে। এই কামাগ্নি অত্যন্ত আহার অর্থাৎ দুষ্পূরণীয় অতএব মহাপাপও বটে। কামের দ্বারা প্রেরিত
হইয়া প্রাণি পাপ করে। সেইজন্য এই কামকে ইহসংসারে বৈরী বলিয়া জানিবে।
ধূমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো
মলেন চ ৷
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ || ৩৮ ||
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ || ৩৮ ||
এই কামরূপ বৈরী কিরূপ তাহা দৃষ্টান্তের দ্বারা
বলা হইতেছে-বহ্নির সহজাত অপ্রকাশাত্মক ধূমের দ্বারা যেমন প্রকাশাত্মক বহ্নি আবৃত থাকে,
অথবা যেমন আদর্শ বা আয়না ময়লা দ্বারা, যেমন উল্ব অর্থাৎ গর্ভবেষ্টন জরায়ুর দ্বারা আবৃত
অর্থাৎ আচ্ছাদিত থাকে, সেইরূপ এই কামের দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে।
আবৃতং
জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা ।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ || ৩৯ ||
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ || ৩৯ ||
হে কৌন্তেয়! জ্ঞানীদিগের নিত্যবৈরী
অর্থাৎ নিত্যশত্রু কাম দ্বারা জ্ঞান আবৃত, জ্ঞানী পূর্ব্ব হইতেই জানেন যে এই কামের
দ্বারা আমি পূর্ব্ব হইতেই অনর্থে প্রযুক্ত আছি। এর জন্য জ্ঞানী নিত্য নিজেকে দুঃখী
মনে করেন। এই জন্য ঐ কাম জ্ঞানীদিগের নিত্যবৈরী পরন্তু মূর্খের নহে। মূর্খ তৃষ্ণাকালে
কামকে মিত্ররূপে দেখে, তারপর তাহার কার্য্যদ্বারা দুঃখপ্রাপ্ত হইয়া মূর্খ জানিতে পারে
যে আমি তৃষ্ণাদ্বারা দুঃখ প্রাপ্ত হইয়াছি। কামরূপ অর্থাৎ কামনা বা ইচ্ছা যাহার স্বরূপ,
যাহা দুষ্পূরণীয় অর্থাৎ অতিকষ্টে পূর্ণ হইয়া থাকে, যাহা অনল সদৃশ ভোগের দ্বারা কখনও
তৃপ্ত হয় না, এইরূপ কামানলের দ্বারা জ্ঞান আচ্ছাদিত।
ইন্দ্রিয়াণি
মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে।
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ || ৪০ ||
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ || ৪০ ||
জ্ঞানের আবরণত্বহেতু সকলের বৈরী
যে কাম তাহার অধিষ্ঠান কোথায়? কেন না শত্রুর অধিষ্ঠান জ্ঞাত হইলে
সুখে শত্রুর নির্বহন বা নাশ করা যাইতে পারে। এ বিষয়টি অপেক্ষা করে শ্রীভগবান বলিতেছেন-
ইন্দ্রিয়
সকল, মন এবং বুদ্ধিকে এই কামের অধিষ্ঠান বা আশ্রয় বলা হইয়া থাকে। এই কাম জ্ঞানকে আবৃত
বা আচ্ছাদন কোরে দেহীদের এইসকল ইন্দ্রিয়াদির আশ্রয়ের দ্বারা বিবিধপ্রকারে মোহিত করে।
তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ
নিয়ম্য ভরতর্ষভ।
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ || ৪১ ||
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ || ৪১ ||
হে
ভরতকূল ঋষভ! সেইজন্য
তুমি ইন্দ্রিয় সকল পূর্বে নিয়মিত অর্থাৎ বশীভূত করিয়া জীবের এই প্রকৃত বৈরী জ্ঞানবিজ্ঞান নাশক এই পাপাচার কাম পরিত্যাগ
কর। জ্ঞান অর্থাৎ শাস্ত্র এবং আচার্য্য
হইতে আত্মাদির অববোধ; বিজ্ঞান অর্থাৎ বিশেষভাবে
তাহার অনুভব। আত্মার শ্রেয়প্রাপ্তির হেতু যে জ্ঞান এবং বিজ্ঞান, তাহাদের নাশক যে কাম
তাহাকে পরিত্যাগ কর-এইরূপ অর্থ।
ইন্দ্রিয়াণি
পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ || ৪২ ||
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ || ৪২ ||
পন্ডিতেরা বাহ্য, পরিচ্ছিন্ন
এবং স্থুল দেহের অপেক্ষা সুক্ষ্মত্ব, অন্তরস্থত্ব, ব্যাপিত্বাদি গুণযুক্ত হওয়ায় শ্রোত্রাদি
পঞ্চ জ্ঞান ইন্দ্রিয়কে পর অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বলেন। তথা ইন্দ্রিয় সকল হইতে সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক
মন শ্রেষ্ঠ। সেইরূপ মন হইতে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। তথা, বুদ্ধি পর্যন্ত সর্ব
দৃশ্য পদার্থের অভ্যন্তর যে দেহী বা জীব, যাহাকে ইন্দ্রিয়াদি আশ্রয়ের দ্বারা যুক্ত
কাম জ্ঞানাবরণ-পূর্বক মোহিত করে, এই কথা যাহার সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, তিনি স্বরূপতঃ
বুদ্ধিরও পর দ্রষ্টা আত্মা।
এবং বুদ্ধেঃ
পরং বুদ্ধ্বা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ || ৪৩ ||
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ || ৪৩ ||
এইভাবে বুদ্ধিরও পর অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ
আত্মাকে জানিয়া, চঞ্চল মনকে সম্যকরূপে স্তম্ভন করিয়া, স্বীয় সুসংস্কৃত মনের দ্বারা
সম্যকরূপে মনকে সমাধিত করিয়া; হে মহাবাহো! দুরাসদ অর্থাৎ অতি দুঃখে যাহার বশ্যতা প্রাপ্তি
হওয়া যায় অর্থাৎ যাহাকে বশ করা যায়, সেই দুরাসদ দুর্বিজ্ঞেয় অনেক বিশেষণযুক্ত কামরূপ
এই শত্রুকে ত্যাগ কর।
ইতি
শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু
ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে কর্ম্মযোগ
নাম তৃতীয়োঽধ্যায়ঃ।
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে কর্ম্মযোগ
নাম তৃতীয়োঽধ্যায়ঃ।
ॐ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।
॥ শ্রীবেদব্যাসায় নমঃ॥ শ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে
নমঃ ॥
No comments:
Post a Comment